
ওমর ফারুক জুয়েল,পার্বত্য চট্টগ্রাম সংবাদদাতা
জুলাই ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতা বৈষম্যের বিরুদ্ধে দুই হাজার সাধারণ শিক্ষার্থী ও জনতার রক্ত, প্রায় ৪০/৫০ হাজার ছাত্র-জনতার অঙ্গহানির বিনিময়ে আন্দোলন সফলকাম হয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য মাটিও রক্তমাখা আন্দোলনে শামিল হয়েছে। ১৯৭১ ও জুলাই ২০২৪ চেতনায় আজও বৈষম্য বিরুদ্ধে পাহাড়ের জনগণ লড়াই করতে প্রস্তুত। যদিও পার্বত্য জনগণ প্রত্যাশা করেছিলেন এই বৈষম্যমূলক নীতি দূর হয়ে পার্বত্য জনগণের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন আরো টেকসই হবে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের প্রত্যাশা প্রতিফলিত হয়নি, হিতেবিপরীত ঘটেছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিরা উন্নয়ন কার্যক্রম ও সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন। এছাড়া, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনের কার্যক্রমের ফলে সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে বাঙালিরা, খুন, গুম, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও অন্যান্য অপরাধের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। (parbattanews)
সার্বিকভাবে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠী উন্নয়ন কার্যক্রম ও সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পার্বত্য বাঙ্গালিরা দাবি করেন, সকল জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।(parbattanews)
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে জাতিগত বৈচিত্র্যের এক অনন্য চিত্র। সেখানে বিভিন্ন সরকারি বরাদ্দে বৈষম্যের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে, পার্বত্য ইতিহাসের এক কলঙ্কময় চিহ্নিত হয়ে থাকবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক বরাদ্দ তালিকা প্রকাশে তা হলো রাষ্ট্রীয় সম্পদের বিতরণে চরম পক্ষপাতিত্ব নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর।
সরকারি বরাদ্দ জনগণের রাষ্টীয় অধিকার। এই অধিকার যখন খর্ব করা হয় পরিকল্পিতভাবে আধিপত্য বিস্তারে তখন থেকে অস্থিতিশীল সূচনা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বরাদ্দের যে চিত্র প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, চাকমা সম্প্রদায়কে একচেটিয়া সুবিধা প্রাপ্ত। যেখানে বাঙালি, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, সাঁওতাল জনগোষ্ঠীকে চরম অবহেলা করা হয়েছে।
সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার বরাদ্দ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণে গ্রহণযোগ্যতা ও সাম্যবোধের প্রতিফলন নেই বিগত থেকে আজও পর্যন্ত ।
তিন জেলা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ২৪২ ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু এই বরাদ্দের মধ্যে বিস্ময়কর জাতিগত সুষম বণ্টন বিদ্যমান নেই।
খাগড়াছড়ি: ১৯৫ ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান পেয়েছে ৩ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা (৭১.০২%)
রাঙ্গামাটি: ৪৪ ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান পেয়েছে ১ কোটি ২২ লাখ ২০ হাজার টাকা (২৭.৭৭%)
বান্দরবান: মাত্র ৩ ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান পেয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা (১.২০%)
উক্ত পরিসংখ্যান তথ্যকোষে, বান্দরবানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও সেখানে বরাদ্দ এক শতাংশের সামান্য বেশি। বান্দরবানের প্রতি চরম শীর্ষে বৈষম্য করা হয়েছে। জাতিগত বিবেচনারড় ভিত্তিতে বরাদ্দের পরিমাণ দেখলে বোঝা যায়, চাকমা সম্প্রদায়কে প্রায় একচেটিয়া সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
রাঙ্গামাটির বরাদ্দ বিশ্লেষণ:
চাকমা: ৩৭ জন (৮৪.০৯%) পেয়েছে ১ কোটি ৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা (৮৬.৫০%) বাঙালি: ৪ জন (৯.০৯%) পেয়েছে ৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা (৬.৯৫%) মারমা: ১ জন (২.২৭%) পেয়েছে ৩ লাখ টাকা (২.৪৫%) ত্রিপুরা: ১ জন (২.২৭%) পেয়েছে ২ লাখ টাকা (১.৬৪%) তঞ্চঙ্গ্যা: ১ জন (২.২৭%) পেয়েছে ৩ লাখ টাকা (২.৪৫%)
উক্ত বরাদ্দে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর প্রতি কী ধরনের আচরণ করা হয়েছে, তা সুস্পষ্ট।
খাগড়াছড়ির বরাদ্দ বিশ্লেষণ:
চাকমা: ১০০ জন (৫১.২৮%) পেয়েছে ২ কোটি ২৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা (৭৩.০৯%) বাঙালি: ৪১ জন (২১.০৩%) পেয়েছে ৪২ লাখ ৯০ হাজার টাকা (১৩.৭৩%) মারমা: ৪২ জন (২১.৫৪%) পেয়েছে ২১ লাখ ৭০ হাজার টাকা (৬.৯৪%) ত্রিপুরা: ১০ জন (৫.১৩%) পেয়েছে ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা (৫.৬০%) সাঁওতাল: ২ জন (১.০৩%) পেয়েছে ২ লাখ টাকা (০.৬৪%)
দৃষ্টান্ত যে, চাকমারা সিংহভাগেই বরাদ্দ পাচ্ছে, অথচ বাঙ্গালিসহ অনান্যরা পাচ্ছে না কেন?
বান্দরবানের চরম বৈষম্য:
বান্দরবানে বরাদ্দ পেয়েছে মাত্র ৩ জন। অর্থাৎ, এখানে পুরো জেলার জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষিত করা হয়েছে বলে জানান পাহাড়ের সচেতন নাগরিক। এই বৈষম্য কেন? এছাড়াও একই ব্যক্তি পেয়েছে একাধিক বরাদ্দ সেটাও দেখা গেছে।
তেলা মাথায় তেল দেওয়ার মতো কাহিনী হয়েছে সরকারি অর্থ বরাদ্দের মূলনীতি হলো—অন্যায়ভাবে কাউকে বেশি সুবিধা দেওয়া মানে অন্যজনকে বঞ্চিত করার শামিল। কিন্তু এখানেও দুর্নীতির প্রকাশ সুস্পষ্ট।
রাঙ্গামাটির রনজ্যোতি চাকমা দু’বার (৩+৩) মোট ৬ লাখ টাকা পেয়েছেন।
বিনৌটি চাকমা ১২টি গ্রুপের নামে ২৫ লাখ টাকা পেয়েছেন।
খাগড়াছড়ির ত্রিনা চাকমা ১২টি গ্রুপের নামে ২৫ লাখ টাকা পেয়েছেন।
অন্যদিকে, বাঙালি, মারমা, ত্রিপুরা, সাঁওতালদের মধ্যে অনেকেই কোনো বরাদ্দই পাননি!
জনগনের প্রতিবাদেও সরকার বৈষম্য সম্পর্কে নিস্তব্ধ থাকে। নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে এই পক্ষপাতিত্ব চালিয়ে যাচ্ছে যা জনমনের প্রশ্ন। চাকমা সম্প্রদায়রা মনে করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম শুধু তাদের জন্য আর কারও নয়। এটি একটি বহুজাতিক অঞ্চল, যেখানে বাঙালি, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, সাঁওতালসহ বহু জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। তাহলে চাকমাদের জন্য এত বেশি বরাদ্দ, আর অন্যদের জন্য বঞ্চিত, অবহেলা কেন?
সরকারের উচিত অবিলম্বে এই বরাদ্দ বাতিল করা। নতুন করে ন্যায়সংগতভাবে বরাদ্দ দিয়ে বান্দরবানে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা। বাঙালি, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, সাঁওতালদের যথাযথ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।
একই ব্যক্তিকে একাধিকবার বরাদ্দ দেওয়া অনৈতিক কাজ। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিরা উন্নয়ন কার্যক্রম ও সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে মনে করেন। তারা দাবি করেন যে, সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন। এছাড়া, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনের কার্যক্রমের ফলে সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে বাঙালিরা, খুন, গুম, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও অন্যান্য অপরাধের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই অপতৎপরতাগুলো গুলো বন্ধ করা সময়ের দাবি।